Menu

কোমর ও অন্যান্য ব্যথা

বিভিন্ন ব্যথা ও তার আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে বিশদে জানুন। ফোন করুন +৯১৯৩৩৯৬৫৭৮৫৭

ব্যথা চিকিৎসার নতুন কথা

ব্যথার চিকিৎসা : একটি দিগন্ত

অ্যালগোলজি (Algology) বা ব্যথা উপশমের বিজ্ঞান হল চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি নতুন উপশাখা। এক্ষেত্রে সমস্ত ধরনের ব্যথার চিকিৎসাই করা হয় কখনও বা মিলিত ভাবে অন্য শাখার চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে। বিগত এক দশকের একটু বেশি সময় ধরে এই শাখার উন্নতি হয়েছে প্রচণ্ড ভাবে। নতুন নতুন গবেষণা যেমন ব্যথার কারণ খুঁজে বের করতে সমর্থ হয়েছে, তেমনি নতুন ধরনের বহু চিকিৎসা পদ্ধতি বেরিয়ে এসেছে, যা অ্যালগোলজি-র নিজস্বতা প্রতিষ্ঠিত করেছে। উন্নত দেশগুলিতে এই চিকিৎসা জনপ্রিয় হলেও, আমাদের দেশে সাধারন মানুষ তো বটেই, চিকিৎসক সমাজের অনেক অংশেই তা পৌঁছয়নি।

বিভিন্ন ধরনের ব্যথা  : শত্রু ও মিত্র

মোটামুটিভাবে ব্যথাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। অ্যাকিউট পেইন (Acute Pain) বা তাৎক্ষণিক ব্যথা এবং ক্রনিক পেইন (Chronic Pain) বা পুরনো ব্যথা। তাৎক্ষণিক ব্যথা আমাদের উপকারি বন্ধুর মতো। এটা একটা অ্যালার্ম যা আমাদের শরীরে অসুস্থতার কথা জানান দেয়। অসুস্থতার চিকিৎসাই এখানে প্রধান, ব্যথার চিকিৎসা গৌণ। কিন্তু ক্রনিক পেইন বা পুরনো ব্যথা হল একটি স্নায়ুগত রোগ। দু একটি ছাড়া সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্যথার চিকিৎসা আসল রোগটিকে সারিয়ে তোলে। ক্রনিক পেইন কোনও অ্যালার্ম নয়, আর এটা বন্ধু তো নয়ই বরং শত্রু বলা যায়।

ব্যথা ভোগের কুফল

আগে ভাবা হত ব্যথা সহ্য করাই ভাল, অন্তত যতটা পারা যায়। এতে নাকি সহ্য ক্ষমতা বাড়বে। বিভিন্ন গবেষণায় কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল বলে প্রমানিত হয়েছে। দেখা গেছে, একটি মানুষ ব্যথা সহ্য করতে থাকলে, তার সহ্য ক্ষমতা তো বাড়েই না বরং দিন দিন কমে যায়। আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের যেসব নার্ভ আমাদের ব্যথার অনুভূতি বহন করে, তাদের মধ্যে এমন কিছু পরিবর্তন আসে যে, ব্যথার অনুভূতি (signals) মস্তিষ্কে পৌঁছানোর আগেই কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এখানেই শেষ নয়। ব্যথার অনুভূতি শরীরে স্ট্রেস্ হরমোন নির্গত করে এবং যার জন্য নানা ক্ষতি হয়। এছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি যেমন বাড়িয়ে দেয়, তেমনি হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও বাড়ে। ব্যথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায়, রক্ত তঞ্চন জনিত রোগের উৎপত্তি ঘটায়, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসের কিছু রোগকে ইন্ধনও যোগায়, ফলে পরবর্তী সময়ে তা বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

এজন্য ব্যথা চিকিৎসার আন্তর্জাতিক সমিতি (International Association for Study of Pain) দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ শ্লোগান বেছে নিয়েছে। ১) ‘ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষের অধিকার’। এবং ২) ‘নীরবে সহ্য নয়…..এর ফল ভুগতে হবে’। এ দুটি শ্লোগান বিগত তিন বছর ধরে প্রতি ১১ অক্টোবর বিশ্ব ব্যথা মুক্তি দিবসে (World day against Pain) দিয়ে এসেছেন গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্যসচেতন মানুষেরা। 

রোগের চিকিৎসা না ব্যথার চিকিৎসা ? 

আগেই আলোচনা হয়েছে তাৎক্ষণিক ব্যথা হয় রোগের কারণে। সেক্ষেত্রে রোগের চিকিৎসা আগে, ব্যথার চিকিৎসা রোগের চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে। শুধুমাত্র ব্যথার চিকিৎসা চলতে থাকলে এই ক্ষেত্রে রোগ বেড়ে যেতে পারে। ক্রনিক পেইন বা পুরনো ব্যথার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু উল্টো। রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস, অস্টিও আর্থরাইটিস ইত্যাদি দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া বেশিরভাগ পুরনো ব্যথা (মানে ৬ মাসের বেশি চলতে থাকা) নিজেই স্নায়ুতন্ত্রের একটি রোগ। শুরুর দিকে রোগটি হয়ত কোনও কারণে সেরে যায় (চিকিৎসার দ্বারা বা চিকিৎসা ছাড়া)। কিন্তু সেই অংশের নার্ভগুলি দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার অনুভূতি বহন করতে করতে নিজেরাই রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন প্রথম সৃষ্টি হওয়া রোগটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু ব্যথাটি সেই নির্দিষ্ট স্থান থেকে আসছে বলে অনুভূত হতে থাকে। এই ক্ষেত্রে রোগগ্রস্ত নার্ভগুলির চিকিৎসাই ব্যথার চিকিৎসা এবং প্রথম রোগটি বেড়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। 

ব্যথার চিকিৎসা কি ভাবে  

অ্যাকিউট পেইন বা তাৎক্ষণিক ব্যথায় প্রচলিত চিকিৎসা কাজ দিলেও কতকগুলি ক্ষেত্রে যেমন অপারেশন বা চোট আঘাত পরবর্তী ব্যথা, প্রসব যন্ত্রণা এবং ক্যান্সারের ব্যথায় বিশেষ ধরনের চিকিৎসা করে রোগীকে পুরোপুরি ব্যথামুক্ত রাখা সম্ভব। সমস্যা হল ক্রনিক পেইন বা পুরনো ব্যথায়। এক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যথার চিকিৎসা একেবারেই কাজ করে না। কিছু বিশেষ ধরনের ব্যথার চিকিৎসা সম্মিলিতভাবে কিছুটা কাজ করে। এর মধ্যে যেমন আছে ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট (Interventional Pain Management), তেমনি আছে কিছু ওষুধ আর সঙ্গে ধ্যান, প্রাণায়াম বা আকুপাংচার।

ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট

ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট হল এমন এক ধরনের ইনভ্যাসিভ (Invassive) পদ্ধতি যার সাহায্যে স্থায়ীভাবে ব্যথা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব। এটা বেশ কিছু পদ্ধতির (বিভিন্ন ধরনের ব্যথার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি) সমষ্টি। এখানে যেমন কখনও ব্যথা পরিবাহী নার্ভগুলিকে স্থায়ীভাবে নষ্ট করে দেওয়া হয় (ক্যান্সারের চিকিৎসায়), তেমনি কখনও তাকে সাময়িকভাবে অকেজো করে রাখাও হয়। কখনও গ্যাংলিওন বা নার্ভ প্লেক্সাস (Ganglion or Nerve plexus) ব্লক করা হয়। কখনও স্লিপ ডিস্কের রোগগ্রস্ত ডিস্কটিকে মেরামত করা হয় বা পেসমেকারের মতো ছোট্ট যন্ত্র শরীরের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এ ধরনের আরও নানা পদ্ধতি নিয়েই ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট। 

ক্যান্সারের ব্যথা : কমানো সম্ভব? 

ক্যান্সারের ব্যথা নিয়ে আলোচনার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা দরকার। যেমন, ভারতে প্রতিবছর ১০ লাখ নতুন করে ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। এদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ রোগী ধরা পড়েন বেশ অ্যাডভান্সড অবস্থায়, যাদের ক্যান্সারের আসল চিকিৎসা ( যেমন – অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি) করা সম্ভব হয় না। এদের ব্যথার চিকিৎসারই শুধু প্রয়োজন হয়। এসব অ্যাডভান্সড ক্যান্সারের রোগীর ৪০ শতাংশ মারা যান অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। অন্তত ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ রোগীর অনুযোগ, চিকিৎসা সত্ত্বেও তাঁদের ব্যথা ঠিকমতো কমছে না। অথচ বিদেশে পরীক্ষামূলক ভাবে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশেরও বেশি রোগীর ব্যথা মুক্তির ব্যবস্থা করা যায়। প্রশ্ন হল আমাদের দেশে ঘাটতিটা কোথায়? কেন আমাদের দেশে ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই ব্যথা কমছে না বলে অভিযোগ করছেন? এর কারণ খুঁজতে গেলে প্রথমেই যেটা নজরে আসবে, সচেতনতার অভাব। স্বাস্থ্যকর্মী, এমনকি চিকিৎসকরাও সচেতন নন কীভাবে ক্যান্সারের ব্যথা কমানো যায় (৩০ শতাংশ রোগী ব্যথা কমানোর ওষুধে উপকৃত হন না, এঁদের ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন)। রোগী বা তাঁদের আত্মীয়স্বজনও সচেতন নন কোথায় এবং কিভাবে ব্যথা কমানো যায়। সরকারি স্তরে উদাসীনতাও একটা বড় কারণ। যত সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক প্রয়োজন, তার ভগ্নাংশও নেই এই দেশে। অথচ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সেভাবে করা হয় না। অন্য দিকে মরফিন জাতীয় ওষুধ যা একান্ত প্রয়োজনীয় ক্যান্সারের ব্যথায়, আইন-কানুনের বেড়াজালে তা প্রায় অমিল। 

ক্যান্সারের ব্যথায় চিকিৎসা 

এ ব্যাপারে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা হু-র নির্দিষ্ট নির্দেশিকা আছে। একে বলা যায় ব্যথা চিকিৎসার সিঁড়ি (Analgesic ladder)। প্রথম ধাপে আছে, মরফিন নয় এমন ওষুধ দিয়ে (যেমন প্যারাসিটামল) চিকিৎসা। দ্বিতীয় ধাপে, মরফিন শ্রেণীর দুর্বল ওষুধ, এর সঙ্গে প্রয়োজনে প্রথম ধাপের ওষুধ যোগ করা যেতে পারে। তৃতীয় ধাপে সরাসরি মরফিন বা ওই জাতীয় বেশী কার্যকর ওষুধ। চতুর্থ এবং শেষ ধাপে, ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট। ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্টের প্রয়োজন হতেই পারে, তবুও এ নির্দেশিকাই সারা পৃথিবীতেই মেনে চলা উচিত। 

ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট

আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে, অন্তত ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের ব্যথার চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। সচরাচর দুই ধরনের ‘ইন্টারভেনশন’ কার্যকরী। প্রথমটি হল নিউরোলিসিস (ব্যথা পরিবাহী নার্ভগুলিকে স্থায়ীভাবে নষ্ট করে দেওয়া), এবং দ্বিতীয়টি ইমপ্ল্যান্টেবল ড্রাগ ডেলিভারি সিস্টেম (এখানে পেসমেকারের মতো একটি যন্ত্র শরীরের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করে স্পাইনাল কর্ডের মধ্যে মরফিন জাতীয় ওষুধ ক্রমাগত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়)। দ্বিতীয় চিকিৎসাটি বেশ ব্যয়বহুল হলেও প্রথমটির খরচ নামমাত্র, যা আমাদের মতো গরিব দেশে অত্যন্ত কার্যকর সাব্যস্ত হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, এই চিকিৎসাগুলি বেশ নিরাপদ। প্রথমটির পার্শ্বক্রিয়ার সামান্য সম্ভাবনা থাকলেও, দ্বিতীয়টির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া একেবারেই নামমাত্র। 

বেদনাহীন প্রসব

বেদনাহীন প্রসব ব্যথা চিকিৎসক এবং ধাত্রীবিদদের যৌথ প্রয়াসেই কেবলমাত্র সম্ভব। উন্নত দেশগুলিতে ৯০ শতাংশ প্রসবই বেদনাহীন ভাবে করানো হলেও আমাদের দেশে তা কোনও ভগ্নাংশেও আসে না। মুম্বাইতে শুরু হয়েছে বটে, তবে কলকাতায় সাধারণ মানুষ তথা অনেক চিকিৎসকের কাছেও পদ্ধতিগুলি অচেনা। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছরের কিছু বেশি সময় আগে যখন প্রথম অ্যানাস্থেশিয়া আবিষ্কৃত হয়েছিল, তখনই চেষ্টা করা হয় সন্তান প্রসব প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ বেদনাহীন করার। প্রথমে ইথার পরে নানা সময় নানা ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, আজ বিশেষজ্ঞরা ‘এপিডুরাল’ পদ্ধতিকে বাচ্চা ও মা-র উভয়ের জন্যই সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছেন। এখন উন্নত দেশগুলিতে বেশিরভাগ সন্তান প্রসবই এপিডুরাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। 

এপিডুরাল পদ্ধতি কী

এটি বুঝতে মেরুদণ্ডের গঠন সম্বন্ধে আমাদের জানা দরকার। আমাদের মেরুদণ্ডটি কতকগুলি ছোট-ছোট হাড় দিয়ে তৈরি। এর মধ্যে আছে একটি নালি, যার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে স্পাইনাল কর্ড বা সুষুম্না কাণ্ড। এ সুসুম্না কাণ্ড থেকেই আমাদের শরীরের বেশিরভাগ নার্ভ বের হচ্ছে প্রত্যেকটি ছোট হাড় (ভার্টিব্রা)-এর নিচ দিয়ে (দু’পাশ দিয়ে একটি করে)। আমাদের শরীরের সমস্ত অনুভূতি (ব্যথা, স্পরশ, ঠাণ্ডা-গরম ইত্যাদি) এই নার্ভগুলি দিয়ে স্পাইনাল কর্ড ধরে মস্তিষ্কে প্রবাহিত হলে, তবেই আমরা সে-সব অনুভূতি টের পাই। এ পথের কোথাও যদি অনুভূতি-সঙ্কেতগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয়, সেক্ষেত্রে কিন্তু তা আমরা অনুভব করব না। স্পাইনাল কর্ডের কতকগুলি আচ্ছাদন আছে। সবচেয়ে বাইরের আচ্ছাদনটির নাম ডুরা। এই ডুরা এবং মেরুদণ্ডের মধ্যবর্তী নালির ভিতরের দেওয়ালের মাঝখানের যে সূক্ষ্ম জায়গা, তাকে বলা হয় এপিডুরাল স্পেস। সেই স্পেস বা পরিসর দিয়েই বিভিন্ন স্নায়ু বের হচ্ছে। এখন এপিডুরাল স্পেস-এ যদি কোনও ওষুধ দিয়ে ওই জায়গা দিয়ে ঢোকা নার্ভ গুলোর মাধ্যমে প্রবাহিত হওয়া সঙ্কেতগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া যায়, তা হলে যে জায়গা থেকে ব্যথা বা অন্য অনুভূতি সঙ্কেত স্নায়ু গুলো বহন করছিল, মস্তিষ্কে তা প্রবাহিত হবে না, ফলে ব্যথাও অনুভূত হবে না। সাধারণত সন্তান প্রসবের সময় একটি সূক্ষ্ম নালিকা এপিডুরাল স্পেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপর শুধুমাত্র ব্যথার অনুভূতি বন্ধ করে (অন্য অনুভূতিকে আটকাবে না), এমন ওষুধ অই জায়গায় জোগান দেওয়া হতে থাকে। ফলে, জরায়ু সঙ্কোচন (প্রসববেদনার মূল কারন) ও সন্তান-প্রসব স্বাভাবিক ভাবে হলেও, জরায়ু থেকে উৎপন্ন ব্যথার সঙ্কেত এপিডুরাল স্পেসে-এ আটকে যাওয়ায় মস্তিষ্কে তা প্রবাহিত হবে না এবং ব্যথাও অনুভূত হবে না। এ পদ্ধতিতে বাচ্চা বা মা-র কোনোরকম ক্ষতির সম্ভাবনা প্রায় নেই। সচেতনতার অভাবই সবচেয়ে বড় কারণ এ ব্যবস্থা জনপ্রিয় না হওয়ার। নতুবা খরচ কিন্তু এমন কিছু নয়। অন্তত সরকারি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা থাকা দরকার যাতে রোগী ব্যথা সহ্য করতে না পারলে, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। 

ক্রনিক পেইন নিয়ে দু-চার কথা

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর স্টাডি অফ পেইন ব্যথার যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেটিই আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী – ব্যথা হল একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি বা আবেগ, যা কলাকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য (Tissue damage) হতে পারে, নতুবা টিস্যু ড্যামেজের কারণেই ব্যথা হচ্ছে বলে মনে হয়। শেষের কথাগুলি খুব দরকারি। সত্যিকারের টিস্যু ড্যামেজ না হলেও ব্যথা অনুভুত হবে এবং যাতে মনে হবে শরীরের সে অংশে টিস্যু ড্যামেজ হচ্ছে। 

একটা প্রকৃত উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা আরও ভালোভাবে বোঝা সম্ভব। ‘ফ্যান্টম লিম্ব পেইন’ (Phantom Limb Pain) রোগীর অঙ্গচ্ছেদ করা হলে কিছু দিন পর এই ধরনের ব্যথা শুরু হয়। কিংবা পা বাদ যাওয়া সত্ত্বেও রোগী মনে করে তার হাত বা পা রয়েছে আর সেই অঙ্গ থেকেই ব্যথার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয়। এখন যে অঙ্গ শরীরে নেই সেখানে কোনও রোগ বা Tissue damage –এর প্রশ্নই ওঠে না, তাহলে কেমন করে সেখানে ব্যথা অনুভূত হবে? ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত ভাবা হত, এটি শরীরের অঙ্গ বাদ দেওয়ার ফলে উদ্ভূত একটি মানসিক রোগ। কিন্তু এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়েছে যে, সেই অঙ্গ থেকে আসা নার্ভগুলি (যা মেরুদণ্ডের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে) থেকেই এ ব্যথার উৎপত্তি। এটা কোনও মানসিক রোগ নয়, একেবারে সত্তিকারের আসল ব্যথা। 

সুতরাং, আগের আলোচনা ধরে বলা চলে, এক প্রকারের ব্যথা Tissue damage বা কলা-কোষ ক্ষতিগ্রস্ত (যেমন চোট-আঘাত, ফোঁড়া, কাটা-ছেঁড়া, অ্যাপেনডিসাইটিস ইত্যাদি) হওয়ার কারণে দেখা দেয়। এ ব্যথা পুরোপুরি শারীরবৃত্তীয় ঘটনা। একে বলা হয় তাৎক্ষণিক ব্যথা (Acute Pain)। অন্য প্রকার ব্যথার পিছনে কোনও শারীরবৃত্তীয় কারণ থাকে না, এখানে ব্যথা পরিবাহী স্নায়ুগুলো নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়ে। একে বলা হয় পুরনো ব্যথা (Chronic Pain)। আবার শুধুমাত্র সময় দিয়েও এইসব ব্যথাকে ভাগ করা যায় না। কিছু ব্যথা, যা হয়ত বছরের পর বছর ধরে চলছে, তাকে ক্রনিক পেইন বলা উচিৎ হবে না, যদি সেটা Tissue damage  থেকে হয় (রিউমাটয়েড এবং অস্টিও আর্থারাইটিস-এর উদাহরণ আগেই দেওয়া হয়েছে)। মোটামুটিভাবে ৩-৬ মাস কোনও ব্যথা চলতে থাকলেই তাকে ক্রনিক পেইন বলা যায়। তবে ক্রনিক পেইন নির্ধারণ করা হয় সময় দিয়ে নয়, অন্যান্য লক্ষণ থেকে। Phantom Limb যেমন ক্রনিক পেইনের একটি আদর্শ উদাহরণ, তেমনি কোমর ও কোমর থেকে পায়ের দিকে ছড়িয়ে পড়া ব্যথা (Sciatica), ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি, C.R.P.S ইত্যাদিও ক্রনিক পেইন-এর উদাহরণ। 

ক্রনিক পেইন-এর ডায়াগনোসিস বা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন। Tissue damage খুঁজে না পাওয়ার ফলে অনেক সময়ই মানসিক রোগের কারণে ব্যথা হছে বলে চিকিৎসকরা নিদান দেন। প্রচলিত ব্যথার ওষুধ এখানে ভাল কাজ করে না। ফলে, ধারণাটা সহজেই বদ্ধমূল হতে পারে। সব মিলিয়ে রোগীর অবস্থা হয় মারাত্মক। এক দিকে ব্যথা না-কমার হতাশা, সেই সঙ্গে ব্যথায় ভোগার হয়রানি। এছাড়া স্নায়ুতন্ত্রে সেরোটনিন কমে যাওয়াতে অবসাদ দেখা দেয় প্রবল ভাবে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর স্টাডি অফ পেইন তাই স্পষ্ট বলছে, রোগী যদি বলেন তিনি ব্যথায় ভুগছেন, তা হলে Tissue damage খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক, ধরে নিতেই হবে তিনি সত্যিই ব্যথায় ভুগছেন। মানসিক বিকার বলে তাকে কখনই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। 

ক্রনিক পেইন-এর চিকিৎসা

আগেই আমরা আলোচনা করেছি প্রচলিত ব্যথার ওষুধ এক্ষেত্রে ভাল কাজ করে না। বেশ কিছু পদ্ধতি একসঙ্গে প্রয়োগ করলে তবেই ভাল ফল পাওয়ার সম্ভাবনা। প্রথমেই আসি ওষুধের কথায়। যে ওষুধ গুলি এক্ষেত্রে কিছুটা কাজ করে তাদের বলা হয় কো-অ্যানালজেসিকস (Co-analgesics)। এর মধ্যে আছে সেরোটনিন-এর মাত্রা বাড়ানো অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট (Anti-depressant), আছে অ্যান্টি-কনভালস্যান্ট (Anti-Convulsant) এবং আরও কিছু। এদের কাজ হল স্নায়ুতন্ত্রে ঘটে যাওয়া কোনও স্থায়ী পরিবর্তনকে আবার স্বাভাবিক করে তোলা। এর সঙ্গে যোগ করা হয় ইন্টারভেনশনাল পেইন ম্যানেজমেন্ট। এটা স্নায়ুতন্ত্রে আবর্তিত হওয়া ব্যথা চক্র বা Pain cycle-কে বন্ধ করে। আর কিছুদিনের জন্য Pain cycle বন্ধ রাখতে পারলে পুরনো ব্যথা পুরোপুরি সেরে যেতে পারে। ধ্যান ও প্রাণায়ামও পুরনো ব্যথা কমানোয় যথেষ্ট কার্যকর। কেন না নিয়মিত ধ্যান ও প্রাণায়াম অভ্যাসে স্নায়ুতন্ত্রের স্থায়ী পরিবর্তনকে আবার স্বাভাবিক করতে পারে। আকুপাংছার-এরও ভূমিকা আছে এ ব্যাপারে। তবে যে-কোনোও একটি পদ্ধতি পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই বিভিন্ন পদ্ধতি একসঙ্গে প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। 

 

 

 

 

ভ্রান্ত-ধারনা

সাধারন মানুষের মধ্যে কোমরের ব্যথা সম্পর্কে অনেক প্রচলিত ধারনা আছে। মানুষের মধ্যে কম শিক্ষাকেই এইসব প্রচলিত ধারণা গুলোর কারন বলে মনে করা হয়। এমনকি আমাদের দেশেও কোমরের ব্যথা সম্পর্কে অনেক প্রচলিত ধারনা আছে। আর এই প্রচলিত ধারনা গুলোর জন্যই কোমরের ব্যাথার সঠিক ব্যাবস্থাপনায় বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখাকে মেনে নিলে কোমরের ব্যথার চিকিৎসায় অনেক সুবিধা হয়।

(১) প্রচলিত ধারনা :-  যতক্ষণ না পর্যন্ত রোগী ব্যথার থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত রোগীকে সম্পূর্ণ বিছানায় বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলা হয়। এছাড়া হাঁটাচলা বারন ও শক্ত কোন জিনিসের ওপর শোয়ার কথা বলা হয়। 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখা :- সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয় যে অনেক দিন ধরে বিছানায় বিশ্রাম নিলে ও হাঁটাচলা বন্ধ করে দিলে তা প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। রোগীকে সর্ববাধিক ২-৩ দিনের জন্য বিছানায় বিশ্রাম নেওয়ার কথা বলা হয়। তাছাড়া রোগীকে বিভিন্ন কাজের মধ্যে থাকতে বা সক্রিয় থাকতে বলা হয়। 

(২) প্রচলিত ধারনা :- লাম্বস্যাকরাল বেল্ট অথবা কোমরের বেল্ট ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখা :- কোমরের বেল্ট ব্যবহার করলে তা কোমরের মাংসপেশী এবং শিরদাঁড়ার পাশের মাংসপেশীগুলোকে দুর্বল করে দেয়। শিরদাঁড়ার পাশের মাংসপেশী গুলো গুরুত্বপূর্ণ পেশী এরা শিরদাঁড়ার স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সাহায্য করে। তাই এই মাংসপেশী গুলোর ক্ষয় হলে তা উপকারের থেকে অপকারই বেশি হয়।

(৩) প্রচলিত ধারনা :- সাধারণত কোমরের ব্যথার কারন হল স্পন্ডিলোসিস্। 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখা :- স্পন্ডিলোসিস্ কোন রোগের নাম নয়। এটি এক্স-রে – এর পরিভাষা। শিরদাঁড়ার যেকোনো অংশের বয়স্কজনিত ক্ষয়কে স্পন্ডিলোসিস্ বলা হয়। বয়স্কদের মধ্যে কোমরের ব্যথার প্রধান কারন হল ফ্যাসেট জয়েন্ট আরথ্রোপ্যাথি, আর মধ্যবয়স্কদের কারন হল ডিস্কের ক্ষয়।

(৪) প্রচলিত ধারনা :- এম.আর.আই-তে স্লিপ্ ডিস্ক বা প্রল্যাপস্ড্ ডিস্ক থাকলে অপারেশন করার কথা বলা হয়।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখা :- যদি স্লিপ ডিস্কের সাইজ ছোট হয়, ওষুধ এবং ফিসিও-থেরাপি করলে তা সেরে যায়। যদি এর সাইজ বড় হয়, ইঞ্জেক্সন বা ওজোন থেরাপিতে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। আর যদি এর সাইজ অনেক বড় হয় এবং পা অবশ হয়ে যায়, বা পা-এর মাংস পেশী দুর্বল যায়, বা প্রস্রাব/পায়খানা আটকে যায়, কেবল তখনই অপারেশনের প্রয়োজন হয়।